চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের  মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ ক্রমেই ছড়াচ্ছে বিশ্বজুড়ে

বাংলার সকাল ডেস্কবাংলার সকাল ডেস্ক
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৪:০৮ PM, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

২০২২ সালে জার্মানির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান একটি রূপক উত্থাপন করেছিলেন। রুপকে তিনি রাশিয়াকে তুলনা করেছিলেন ঝড়ের সঙ্গে, আর চীনকে তুলনা করেছিলেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে। (Russia is the storm; China is climate change). তাঁর সেই উক্তিই যেনো আজ বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে, বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে অশান্ত এক ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ। এই বৈশ্বিক সংকটের জন্য দায়ী ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন- যা প্রায় এক বছর ধরে আন্তর্জাতিক মনোযোগ কেড়েছে।

২১ শতকের মূল চালিকাশক্তি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে চলমান প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে একটি চীনা বেলুনের মার্কিন আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ বিতর্ক আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ওয়াশিংটন বিষয়টিকে চীনা গুপ্তচরবৃত্তির একটি বৃহত্তর কর্মসূচির অংশ বলে দাবি করেছে। গত নভেম্বরে বালি জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বৈরিতা বন্ধ করার  সংকেত সত্ত্বেও, দুটি শক্তি স্পষ্টতই বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের লড়াইয়ে লিপ্ত। এই নতুন শীতল যুদ্ধের ডানা নীল গ্রহের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রমেই  প্রসারিত হচ্ছে।

বেশ কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা দেখায় যে, দুটি পরাশক্তি অভ্যন্তরীণভাবে যা কিছুই  করুক না কেন-যেমন তাদের সামরিক, প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক পেশীকে শক্তিশালী করতে চাওয়া- উভয়ই বিভিন্ন উপায়ে তাদের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী। এই উত্তেজনা বেশ কিছুদিন ধরেই বাড়ছে। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর চায়না মোবাইল এবং চায়না টেলিকম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া-মধ্য পূর্ব-পশ্চিম ইউরোপ ৬ সাবমেরিন কেবল প্রকল্প থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেয়, যখন আমেরিকান ফার্ম সাবকমকে চীনের প্রধান ফাইবার-অপটিক কেবল প্রস্তুতকারক হেংটং মেরিন-এর  জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল।

এই বছরের শুরুতে, ফিলিপাইন পেন্টাগনকে তার আরও চারটি সামরিক ঘাঁটিতে প্রবেশাধিকার দিয়েছে। ইতিমধ্যে, জাপান এবং নেদারল্যান্ডস চীনে মাইক্রোচিপ রপ্তানির উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়েছে ,অন্যদিকে টোকিও এবং ওয়াশিংটন তাদের প্রতিরক্ষা জোট প্রসারিত করেছে। ২০২২ সালের গ্রীষ্মে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে চারটি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে কৌশলে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল, বিশেষত চীনা কার্যকলাপকে অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে তাইওয়ান আমেরিকান সরকারের কাছ থেকে সামরিক খাতে অর্থ সাহায্য  পাবে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্য হাইপারসনিক অস্ত্র অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পারমাণবিক সাবমেরিনগুলিতে তাদের সহযোগিতা সম্প্রসারণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলো।

এদিকে, চীন ইউক্রেন আক্রমণের ঠিক আগে রাশিয়ার সাথে একটি “নিঃশর্ত” সম্পর্ক নিশ্চিত করেছে। তারপরে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তেল-সমৃদ্ধ রাজ্যের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার অভিপ্রায়ে সৌদি আরবের রিয়াদে একটি গুরুত্বপূর্ণ সফর করেছিলেন। যখন ওয়াশিংটনের সাথে সৌদির সম্পর্ক অবনতির দিকে।মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে দেখা করার জন্য সফরের এক মাস আগে, চীনা রাষ্ট্রপতি বেইজিংয়ে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজকে স্বাগত জানান।

এই বৈঠকটিকে অনেকেই দেখছেন ইউরোপকে সম্পূর্ণরূপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাত মেলাতে বাধা দিতে  চীনের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে। চীন সরকারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ- (যাকে নিউ সিল্ক রোড নামেও উল্লেখ করা হয়) যা পশ্চিম চীন থেকে পশ্চিম রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত একটি  অবকাঠামো প্রকল্প, সাম্প্রতিককালে আলোচনার গুরুত্ব হারিয়েছে। ফরাসি বিনিয়োগ ব্যাংক নাটিক্সিসের এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া হেরেরো বলছেন -”আমরা এক ধরনের শীতল যুদ্ধের মধ্যে আছি। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে একটি দুর্দান্ত কৌশলগত প্রতিযোগিতা প্রত্যক্ষ করছি, যারা কেবল তাদের নিজস্ব বোর্ডে নয়, বিশ্বব্যাপীও খেলছে। অনেকেই ভেবেছিলেন বালিতে শি -এর সাথে বাইডেনের সাক্ষাতের পর হয়তো তাপমাত্রার পারদ নামবে, আমি মনে করি এর কোনো পরিবর্তন হবে না। শুধুমাত্র এই কারণেই নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনে রপ্তানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করছে, বরং উভয় দেশের একটি এজেন্ডা রয়েছে যা কঠিন প্রতিযোগিতার দিকে নির্দেশ করে।”

বোস্টন ইউনিভার্সিটির পারডি স্কুল অফ গ্লোবাল স্টাডিজের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক জর্জ হেইন ( চীনে চিলির রাষ্ট্রদূত হিসাবেও কাজ করেছেন ) বলেছেন যে ”আমরা একটি দ্বিতীয় ঠান্ডা যুদ্ধের মুখোমুখি হচ্ছি। ২০২০ সাল থেকে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সেইসময়ে এটি কোনো সামরিক প্রভাব ছাড়াই একটি বাণিজ্যিক-প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু এখন সংঘাতের পরবর্তী উপাদানগুলি এই দ্বন্দে সম্পৃক্ত হতে চলেছে , যা ক্রমেই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে।অবশ্যই, চীনের অর্থনীতির আকার এবং দুই দেশের পারস্পরিক নির্ভরতার কারণে এই দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধর সঙ্গে  প্রথমটির  পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু, আরও অনেক উপাদান রয়েছে যেদিক থেকে বিচার করলে এই ঠান্ডা যুদ্ধ খানিকটা একই রকম। এবং অবিলম্বে এটি পরিবর্তিত হবে এমন কোনও লক্ষণ নেই। ”

বার্লিন-ভিত্তিক মার্কেটর ইনস্টিটিউট ফর চায়না স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক মিকো হুওতারির মতে, ” পার্থক্য থাকলেও প্রথম স্নায়ুযুদ্ধের সাথে দৃঢ় মিল স্পষ্ট। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার উপাদান থেকে আদর্শগত দ্বন্দ্ব এখানেও উপস্থিত। আমরা ধীরে ধীরে সংঘাতের একটি প্রবাহে প্রবেশ করেছি।”

আপনার মতামত লিখুন :